ইবলিশ: এক প্রোটোকল ভাঙানিয়া— সুশোভন রায়চৌধুরী
পড়ছিলাম রাহেবুল
সম্পাদিত 'ইবলিশ Break The Protocol'। পত্রিকার ট্যাগ লাইন 'Break the protocol' থেকেই বোঝা যায় পত্রিকাটির
চরিত্র সম্পর্কে। হ্যাঁ, একটি নিরেট
প্রতিষ্ঠানবিরোধি পত্রিকা। প্রথমেই পড়লাম সম্পাদকীয়, বলা ভালো "অসম্পাদকীয়"। শ্রদ্ধেয় সম্পাদক এটিই
ব্যবহার করেছেন। এবং প্রথমেই গতানুগতিক সম্পাদকীয়র যে ধারণা আমাদের মনের মধ্যে
থাকে, তাকে ভেঙে চুরমার করে
দিয়েছেন। দেওয়াটাই স্বাভাবিক কারণ ইবলিশ প্রোটোকল ভাঙার কথাই বলে। এই পত্রিকার সব
চাইতে মনোগ্রাহী বিষয়টি হলো, মাঝে মাঝে
সম্পাদকীয় টীকার উপস্থাপন, যা
সুপরিকল্পিতভাবেই সাধু ভাষায়। আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি, ক্রমান্বয়ে পড়তে থাকলে, ভাষার মোনোটোন কাটাতে সাহায্য করে এই সাধু
ভাষার প্রয়োগ। আর প্রত্যেক টীকাতেই পত্রিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধি চরিত্র বিদ্যমান।
যেমন অসম্পাদকীয়র নীচে প্রকাশিত হয়েছে— "সম্পাদকের অসীম আলস্যের কারণে চার-পাঁচ বৎসর পূর্বে
প্রকাশিত ইবলিশের শেষ সংখ্যার সম্পাদকীয় বা অ-সম্পাদকীয়টিই পুনর্মুদ্রিত হলো।
ইহাতে নুতন সংখ্যার অমঙ্গল হয় কী মুখ উজ্জ্বল? তাহা জানিতে হইলে পত্রিকা-পাঠ আবশ্যক, বলেছে মনের ডাক্তারে!" অথবা
"বিজ্ঞপ্তি, বোলে তো লেখাপত্তর আহ্বান!!"
সংখ্যাটি সেজে
উঠেছে, কবিতা, গ্রন্থ সমালোচনা, গল্প,
গদ্য, প্রবন্ধ,
হাইকুর
সমারোহে এবং প্রত্যেকটি লেখাই স্বতন্ত্র তার নিজস্ব পরীক্ষা-নীরিক্ষার গুণে। স্থান
পেয়েছে লিটল ম্যাগাজিন পরিক্রমাও। প্রথমেই বলতে হয় ফারহানা সিদ্দিকার 'ফেবুরঙ্গ' শীর্ষক লেখাটির
কথা। গদ্যটি সাধু ভাষায় লেখা এবং অতিসামান্য বিষয় উপস্থাপনা গুণে কতটা চমকপ্রদ
হয়ে উঠতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই লেখাটি। লেখাটির শেষে
লেখিকা লিখেছেন, "দুঃখটাকে
জোরালোভাবে প্রকাশ করিবার জন্য আমি সাধুভাষা ব্যবহার করিলাম মিত্রোঁসকল। গুরু
চণ্ডালে এক আসনে বসাটাকে যাহারা দোষ মনে করেন, আমার চোখে আদতে তাহারাই দোষী। সুতরাং তাহা অন্বেষণের
চেষ্টাই বৃথা।" ফেসবুকের মতো একটি কন্টেম্পোরারি প্রযুক্তি নির্ভর বিষয়কে
সাধুভাষায় উপস্থাপন নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ,
করে
তুলেছে কিছু মাত্রায় মনোরঞ্জকও। তবে মনের ভাবকে জোরালোভাবে প্রকাশ করবার মাধ্যম
হচ্ছে সাধু ভাষা, এই যুক্তির প্রতি
মতান্তর রয়েই গেল। উল্লেখ্য তৈমুর খানের 'ধর্ম যখন
মানবিকতার অন্তরায়' শীর্ষক প্রবন্ধটিও
সাধু ভাষায় লেখা এবং অবশ্যই সময়োপযোগী। মণিদীপা সেন এর 'অসমক্ষ' গল্পটি প্রশংসার দাবী
রাখে। চোখের পলকেই তিনি পাঠককে রিয়ালিজম থেকে নিয়ে যান সুররিয়াল জগতে, যেখানে তাঁর শব্দের বুনন আনে আলাদা ব্যঞ্জনা, গল্পটির রেশ কাটতে সময় লাগে। 'প্রথম কাব্যির পরশ'
বিভাগে
কবি সুধীর সরকার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন কবি উদয়ার্ণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম
কাব্যগ্রন্থ 'মৃত্যুর পরে যে
ঘোড়ায় চড়ে তুমি দেশ পেরোবে'। সমালোচক
সুণিপুনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন কবির কবিতা যেখানে কোনো তাত্ত্বিক অভিনিবেশ নয় বরং
আবেগ ও স্পন্দনের মধ্যে ধরতে চেয়েছেন কবির কাব্য প্রতিভা, তাঁর কবিতা যাপনকে। পাঠপ্রতিক্রিয়া বিভাগে
আলোচিত হয়েছে কবি সুমন সাধুর 'গওহর জান' ও কবি মুক্তি মণ্ডলের 'পুষ্পপটে ব্রাত্য মিনতি'। দুটি লেখাই পাঠককে আগ্রহী করে তোলে গ্রন্থ দুটির প্রতি, অনুসন্ধিৎসু করে তোলে তাঁদের কাব্যভুবনের
আস্বাদ গ্রহণে। ব্লগবুক বিভাগের সংযোজনটি সংখ্যাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। 'কালিমাটি অনলাইন'
পত্রিকার
সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে যেখানে সম্পাদক কাজল সেন তাঁর 'রামনাম' শিরোনামের
লেখাটিতে লিখেছেন ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্মীয় স্লোগানের অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে, আর প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের লেখা, দীনেশচন্দ্র
সেন-এর 'রামায়ণী কথা' গ্রন্থের ভূমিকা।
সংখ্যাটির কবিতা
বিভাগ সুনির্বাচিত এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। আলাদা করে কোনো লেখার উল্লেখ করা মানে, সামগ্রিকভাবে বিভাগটির গুণগত উৎকৃষ্টতাকে ছোটো
করা। ভালো লেগেছে উমাপদ করের হাইকু। ঋদ্ধ করে লিটল ম্যাগাজিন বিভাগে প্রকাশিত
আলোচনাগুলি।
এক কথায়, ইবলিশ তার প্রতিষ্ঠানবিরোধি চরিত্র স্থাপনে
সম্পূর্ণরূপে সফল যেখানে শ্রদ্ধেয় সম্পাদক রাহেবুলের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় লেখকদের
সাহায্য করেছে প্রথা ভাঙার পথে। মুগ্ধ করে বিনায়ক দত্তের অলংকরণ। সংখ্যার
পারিপাট্যে রয়েছে দৃষ্টিনান্দনিকতা।
'আত্মঘাতী চাষা'-র উদ্দেশ্যে
উৎসর্গিত এই সংখ্যা আশা করি সমাদৃত হবে পাঠকের কাছে।
পত্রিকা- ইবলিশ
সম্পাদক- রাহেবুল
সংখ্যা- আগস্ট
২০১৯
মূল্য- কম-বেশি ১০০
টাকা
প্রাপ্তিস্থান- সুপ্রকাশ বইঘর
(+919477530440), ধ্যানবিন্দু (+919836671203) এবং থিংকার্স লেন
(অনলাইনে)
 |
| ইবলিশ: চতুর্থ সংখ্যা |